পাশ্চাত্যের তথাকথিত বামপন্থা ও দক্ষিণপন্থার রাজনীতি ভারতকে সেই অর্থে কখনই এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে না। এর কারণ বুঝতে গেলে অবশ্য আমাদের ভারতীয় সভ্যতার চিন্তাধারাকে বুঝে নিতে হবে, সেই সূত্রে আমাদের একটু ফিরে তাকাতে হবে প্রাচীনকালের দিকে – যখন পাশ্চাত্যের দেশগুলি সভ্য হয়ে ওঠার চেষ্টা করছে, আর ভারত তখন পরম আনন্দের খোঁজ করতে করতে মানবচেতনা ও জগতের অস্তিত্ব সম্বন্ধীয় আলোচনায় অনেক দূর এগিয়ে গেছে – যা আমরা বেদান্ত ও যোগশাস্ত্রে দেখতে পাই। এদেশে উদ্যাপন থেকে শোকজ্ঞাপন, বা মানুষের যেকোনো দৈনন্দিন কাজ – সবকিছুই একটা আধ্যাত্মিক ভিত্তির উপর গঠিত ছিল। নেতাজি চেয়েছিলেন স্বাধীন ভারতের রাজনীতিতে দক্ষিণপন্থীদের জাতীয়তাবাদ ও বামপন্থীদের আর্থসামাজিক সমতার মতাদর্শকে মিলিতভাবে বজায় রাখতে, কিন্তু সেটা কখনই পাশ্চাত্যের বামপন্থার মতো ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে নয়। বরং বেদান্তের আধ্যাত্মিক চেতনার উপর ভিত্তি করেই আর্থসামাজিক সমতা বজায় রাখার চেষ্টা করতে হবে, অর্থাৎ সকলের মধ্যে সেই এক অনন্ত সত্যকে পূজার মাধ্যমে সকলের প্রতি সমদৃষ্টি রেখে – আসলে নেতাজী তো স্বামী বিবেকানন্দের ভক্ত ছিলেন, স্বামীজির বাণীই যে তাঁর জীবনের আদর্শ। অর্থাৎ নেতাজীর এই ভারতীয় ভাবধারার সমাজতন্ত্র কিন্তু পাশ্চাত্যের সমাজতন্ত্রের থেকে কিছুটা পৃথক। তবে নেতাজী থাকলে এটাও অবশ্যই চাইতেন যে শাসক তাঁর শাসনব্যবস্থায় সমস্ত ধর্মীয় সম্প্রদায় থেকে সর্বদা নিজেকে দূরে রাখবে। কোনো সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু থাকবে না আলাদা করে – ভারতীয়দের শুধু ভারতীয় হিসেবেই গণ্য করা হবে। দেশের আইন সকলের জন্য সমান হবে। আবার আমার মতে, দু'টি ভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের মানুষ বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হলে কাউকেই যেন ধর্মান্তরিত হতে না হয়। সংখ্যাগুরু ও সংখ্যালঘু বিভাজন হলে কিছু রাজনৈতিক দল তাদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের তোষণ করতে থাকে, এবং বহুদিন যাবৎ এমন হতে থাকলে সংখ্যাগুরুদের মধ্যে একদল মানুষ ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের উগ্রতা প্রকাশ করে - তাতে ভেদাভেদ আরও বাড়ে।
সাধারণত মানুষের জীবনে আপাতভাবে যে লক্ষ্য থাকে তা হল কর্মের দ্বারা বাসনাপূরণ। ইন্দ্রিয়সুখের বাসনাগুলিকে আমরা “কাম” বলি এক্ষেত্রে, আর কর্মের দ্বারা যে উপার্জন করছি বা ফল লাভ করছি (যা আমার ওই বাসনা পূরণ করছে) তাকে বলছি “অর্থ”। সনাতন ধর্মের পুরুষার্থ অনুযায়ী এই কাম ও অর্থ হওয়া উচিৎ ধর্মের সীমানার ভেতর। “ধর্ম” বলতে এখানে একটা ‘moral framework’ যা আমাদের জীবনকে ধারণ করে রাখে এবং পতন হতে দেয় না, অর্থাৎ নৈতিকতা, কর্তব্য, মূল্যবোধ ইত্যাদি। তাই গান্ধীজিও চাইতেন যে রাজনীতিতে যেন ধর্ম বজায় থাকে। ভারতীয় রাজনীতি আজ সেই ধর্ম থেকে অনেক দূরে - শুধুই স্বার্থান্বেষীদের অনৈতিকভাবে ক্ষমতা দখলের খেলা। আমাদের দেশে এখন নেতার থেকে সেবকের প্রয়োজন আগে।
ভারতের জাতীয়তাবাদ যত না (পাশ্চাত্যের দেশগুলোর মতো) একটি ভূখণ্ডকে কেন্দ্র করে তার চেয়ে অনেক বেশি সাংস্কৃতিক, যার মূলে রয়েছে প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা সনাতনী অধ্যাত্ম চেতনা যা পাশ্চাত্যকে বারংবার আকৃষ্ট করেছে, কারণ এর প্রধান উদ্দেশ্য মানুষকে সংসারের দুঃখ-সুখের চক্র থেকে মুক্ত করে স্থায়ী আনন্দের খোঁজ দেওয়া। ভারতের এই সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদের মধ্যে রয়েছে তার নিজস্ব সঙ্গীত (গীতি, বাদ্য, নৃত্য), নাট্য, কাব্য ইত্যাদি। এদেশে শিক্ষারও একটা বড় জায়গা ছিল প্রাচীনকালে। সমাজের মাথা ছিল ব্রাহ্মণরা। প্রাচীন ভারতে বংশ পরিচয় নির্বিশেষে যে শিক্ষায় সত্যিই পণ্ডিত হতো সে-ই ব্রাহ্মণ হতে পারত - এই ব্রাহ্মণরাই হতো পরবর্তী শিক্ষক। অর্থাৎ সমাজের মাথায় ছিলেন শিক্ষকরা। আমি এখানে শুধু প্রাচীন ভারতের কথাই বলছি, মধ্যযুগের ব্রাহ্মণ্যবাদ বা পুরোহিততন্ত্রের কথা একেবারেই বলছি না। এই কথাকে মাথায় রেখে ভারতীয় সমাজে আবারও যেন শিক্ষকদের উচ্চতম স্থান দেওয়া হয়, এতেই দেশের মঙ্গল।
তাই ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতাকে ত্যাগ করা বামপন্থা চাই না যা মানুষকে পশু বা যন্ত্রের পর্যায়ে নামিয়ে আনে, ভারতের সনাতনী অধ্যাত্মচিন্তার ভাবধারায় গড়ে ওঠা সমাজতন্ত্র প্রয়োজন। আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদ চাই না, চাই সমন্বয়। আবার সংখ্যাগুরুদের সমর্থনে এমন উগ্র জাতীয়তাবাদও প্রয়োজন নেই যা অযথা সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করে ঘৃণার আবহ তৈরি করে, কারণ তা সনাতন আদর্শের পরিপন্থী - জ্ঞানী হোক বা মূর্খ, দরিদ্র হোক বা ধনী, এবং যে সম্প্রদায়েরই মানুষ হোক, একজন ভারতীয় যেন আরেক ভারতীয়কে নিজের আত্মীয় মনে করে, একে অপরের পাশে দাঁড়াতে পারে - এটাই হবে সঠিক জাতীয়তাবাদ। আবার ধর্মীয় নিপীড়নের কারণে যারা ঘরছাড়া হয়ে আমাদের দেশে চলে আসছে তাদেরও সম্ভব হলে যাতে আমাদের সংস্কৃতিতে সমন্বিত করতে পারি সেটাও দেখতে হবে।