ভারতীয় দর্শনে সৃষ্টিতত্ত্ব ও জগৎ

profile
Uttoran Roychowdhury
Nov 07, 2020   •  66 views

ভারতীয় দর্শন, প্রধানত সাংখ্য ও বেদান্তদর্শন থেকে সৃষ্টিতত্ত্ব ও জগৎ সম্পর্কে যে ধারণা পাওয়া যায় সেটাই কিছুটা নিজের মতো করে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম।

প্রথমেই যে ধারণাটি উপস্থাপন করা হচ্ছে সেটি আমরা পূজ্যপাদ স্বামী বিবেকানন্দের কথাতেই পাই। একটি ছোট্ট বীজ রূপান্তরিত হয় একটি বিরাট বৃক্ষে। অর্থাৎ একটা বীজের মধ্যেই একটা সম্পূর্ণ গাছ থাকে, তবে সেটা অব্যক্ত অবস্থায় — বিজ্ঞানের ভাষায় বলা যায় একটা সম্পূর্ণ গাছের সম্ভাবনা ও জেনেটিক তথ্য ভ্রূণ অবস্থায় বীজের মধ্যে নিহিত থাকে। বীজের মধ্যে এই অব্যক্ত অবস্থা থেকেই ব্যক্ত হয় সেই বৃক্ষ। আবার সেই গাছ মৃত্যুর পূর্বে বীজ রেখে যায়, যার মধ্যে আবারও সম্পূর্ণ গাছের সম্ভাবনা লুকিয়ে থাকে। একইভাবে একটা ডিমের মধ্যেই অব্যক্ত থাকে একটা গোটা পাখি, সেই পাখি ডিম ফুটে বেরিয়ে নিজেকে ব্যক্ত করে, আবার জীবদ্দশায় ডিমের মধ্যে দিয়ে অব্যক্ত পাখিকে রেখে যাচ্ছে। এই চক্রাকার পদ্ধতিতেই প্রকৃতির গতি আবহমান — 'কারণ' (cause) থেকে 'কার্য' (effect) ব্যক্ত হচ্ছে, সেই কার্য থেকেই আবার কারণে ফিরে যাওয়া। যেমন, জল বাষ্পীভূত হয়, তা থেকেই ক্রমে মেঘ তৈরি হয়, আবার সেই মেঘ একসময়ে বৃষ্টির জল হয়ে ঝরে পড়ে। প্রতিটি দেহ, প্রতিটি বস্তুর সম্ভাবনা প্রকৃতির মৌলিক পদার্থ ও শক্তির (matter & energy) মধ্যে সূক্ষ্ম অবস্থায় রয়েছে, তা থেকেই এই বস্তু বা দেহ নিজেকে স্থূলরূপে ব্যক্ত করে, আবার অন্তিমকালে তা প্রকৃতিতেই বিলীন হয়ে যায়। প্রকৃতির এই খেলা সর্বত্র বিদ্যমান। এ থেকে আমরা এই ধারণা করতে পারি যে সামগ্রিকভাবে এই জগৎ-ও একইভাবে চলছে। অর্থাৎ, এক অব্যক্ত বীজ অবস্থা থেকে বিবর্তিত হয়ে এই বৈচিত্র্যময় জগৎ ব্যক্ত হয়, আবার ক্রমে এককালে এই জগৎ লয় হয়ে তার বীজ অবস্থায় ফিরে যায়। কিন্তু কী এই জগতের বীজাবস্থা?

বেদান্ত বলছে এক ও অখণ্ড ব্রহ্মই একমাত্র সত্য, ব্রহ্ম ব্যতীত কিছুই নেই। কী এই ব্রহ্ম? 'ব্রহ্ম' কথাটির আক্ষরিক অর্থ 'বিস্তার'। কতটা বিস্তার? বেদান্ত বলছে 'অনন্ত' বিস্তার, অর্থাৎ যা দেশ (space), কাল (time) ও বস্তু দ্বারা পরিচ্ছিন্ন নয় বা সীমিত নয় — সর্বব্যাপী, চিরন্তন ও অদ্বৈত। বলা হচ্ছে এই ব্রহ্মই 'পরম অস্তিত্ব' (Absolute Existence), আবার এই 'পরম অস্তিত্ব' হলেন 'চৈতন্যস্বরূপ' (Consciousness)। কেন এমন বলা হচ্ছে তা আমরা পরবর্তীতে দেখতে পাব। এই পরম সত্য নাম, রূপ, গুণ, কর্ম, কার্য-কারণ ইত্যাদি সকল আপেক্ষিকতার ঊর্ধ্বে।

এই ব্রহ্ম, যিনি জ্ঞান-অজ্ঞানের পার, যিনি ব্যতীত অন্য কিছুই নেই, তিনি নিজেই আপাতভাবে জ্ঞাতা (subject) ও জ্ঞেয় (object) রূপে প্রকাশিত হন। কীভাবে? কেন? তা এই আপেক্ষিকতার দ্বৈতভূমি থেকে সীমিত মন-বুদ্ধি দ্বারা ধারণা করা সম্ভব নয়, তাই বাক্যে প্রকাশ করাও অসম্ভব। এই জ্ঞাতাকে বলা হয় 'পুরুষ' — যিনি সাক্ষীস্বরূপ অনন্তচৈতন্য। এই পুরুষ যে জ্ঞেয়-বস্তুর সাক্ষী তা-ই হল 'প্রকৃতি'। প্রকৃতি গতিময় কিন্তু জড় (অচেতন), পুরুষ নিশ্চল সাক্ষীচৈতন্য (Witness Consciousness)। তবে এই প্রকৃতি প্রথমে অব্যক্ত থাকে, তার মধ্যেই সুপ্ত অবস্থায় থাকে সৃষ্টির মৌলিক উপাদান — পদার্থ ও শক্তি, গুণত্রয় (সত্ত্ব, রজঃ, তমঃ), এবং দেশ ও কাল। এটাই হল জগতের কারণ বা বীজাবস্থা। এ যেন সুষুপ্তি বা গভীর ঘুমের মতো এক অবস্থা — গভীর ঘুমে যেমন শারীরিক ও মানসিক স্তরের কোনো অনুভূতি থাকে না, দেশ-কালের জ্ঞান থাকে না, শুধুই শূন্যতার সাক্ষী হই আমরা। তেমনই, এ হল জাগতিক সুষুপ্তি — প্রকৃতি অব্যক্ত থাকার কারণে পুরুষ দেশ-কাল-গুণ রহিত এক শূন্যতার সাক্ষী।

আমরা সকালে ঘুম থেকে ওঠার আগে কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে আসি। প্রথমে শেষ রাত বা ভোরের দিকে সুষুপ্তির শূন্যতা থেকে ধীরে ধীরে স্বপ্নাবস্থায় ফিরি। সেখানে মনের মধ্যে স্বপ্নের এক সূক্ষ্ম জগৎকে আমরা অনুভব করি। বেশ কিছুক্ষণ সেই স্বপ্ন চলার পর আমরা ধীরে ধীরে স্থূল জগতে ফিরে আসি — অর্থাৎ ঘুম ভাঙে। ঠিক একইভাবে অব্যক্ত প্রকৃতি থেকে ক্রমে দেশ, কাল, গুণত্রয় এবং মৌলিক পদার্থ ও শক্তি সূক্ষ্ম অবস্থায় ব্যক্ত হতে থাকে। সেই সূক্ষ্ম মৌলিক উপাদান (সাধারণত একেই তন্মাত্রা বলা হয়) তিন গুণের তারতম্যে মিশ্রিত হলে ওই সূক্ষ্ম দেশ ও কালের মধ্যে এক সূক্ষ্ম জগৎ (subtle universe) অভিক্ষিপ্ত (projected) হয়। এরপর প্রকৃতির এইসকল সূক্ষ্ম উপজাত বস্তু থেকে স্থূল উপাদানসমূহ ব্যক্ত হতে থাকে। একইভাবে তিন গুণের তারতম্যে সেই স্থূল মৌলিক উপাদান (একেই আমরা মহাভূত বলে থাকি) মিশ্রিত হয়ে দেশ ও কালের গণ্ডিতে এক স্থূল জগৎ (physical universe) অভিক্ষেপ করে।

আবার, আমরা যখন ঘুমোতে যাই তখন প্রথমে তন্দ্রায় চোখ লেগে আসে এবং সেই পাতলা ঘুমে আমরা ছোট কিছু স্বপ্নের মতো দেখতে পাই, এবং ধীরে ধীরে গভীর ঘুমে ঢলে পড়ি। একইভাবে সময় এলে এই জগৎ-ও লয় হবে — প্রথমে স্থূল জগৎ সূক্ষ্ম জগতে লয় হয়, এরপর সূক্ষ্ম জগৎ-ও লয় হলে প্রকৃতি অব্যক্ত অবস্থায় ফিরে যায়।

প্রকৃতি যে প্রথমে অব্যক্ত অবস্থা থেকে ব্যক্ত হয়ে এক জগতের আপাত সৃষ্টি (apparent creation) করছে, সেই বৈচিত্র্যময় জগতে কার্য-কারণের নিয়মে খেলা চলছে, এবং কালে সেই জগৎ আবার বীজ অবস্থায় লয় হচ্ছে — এই সম্পূর্ণ ব্যাপারটাকে এককথায় 'মায়া' বলি আমরা, এবং নির্গুণ পুরুষ তার সাক্ষী। এখন সেই নিশ্চল নির্গুণ অনন্তচৈতন্য যখন এই মায়া বা প্রকৃতির গতিময়তার মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হন, তখন মনে হয় যেন সেই চৈতন্যস্বরূপ সত্তাই 'সৃষ্টি-স্থিতি-লয়' খেলার মাধ্যমে এই জগৎকে নিজের মধ্যে থেকেই প্রকাশ করছেন, পালন করছেন এবং আপাতভাবে ধ্বংস করে নিজের মধ্যেই লয় করছেন। গুণাতীত ব্রহ্মই যেন 'সগুণ ব্রহ্ম' রূপে প্রকাশিত — তাঁকেই আমরা ঈশ্বর বলি। তাঁর থেকে পৃথক কোনো জগৎ নেই।

মায়া হল 'সদসদ্ভ্যামনির্বচনীয়', অর্থাৎ আছে-ও বলা যায় না আবার নেই-ও বলা যায় না। 'নেই' বলা যায় না কারণ প্রকৃতির খেলা আমাদের ইন্দ্রিয় ও মনের সামনে স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছে, 'আছে' বলা যায় না কারণ আমরা জানি যে প্রকৃতির নিজস্ব কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব নেই, স্বয়ং ব্রহ্মই এই প্রকৃতির অস্তিত্ব, কারণ ব্রহ্মই পুরুষ ও প্রকৃতি রূপে প্রতীয়মান। তাই ব্রহ্ম থেকে পৃথক কোনো অস্তিত্ব প্রকৃতির নেই, ব্রহ্ম স্বয়ং এই জগতের প্রতিটি কণার অস্তিত্ব। তাই ব্রহ্মকেই পরম অস্তিত্ব বলা হচ্ছে। আর পুরুষ? সাক্ষীচৈতন্য পুরুষ তো স্বরূপত ব্রহ্মই — পুরুষের 'আলোয়' প্রতিভাত প্রকৃতি, পুরুষই তার সাক্ষী; যদিও পুরুষ ও প্রকৃতি আসলে অভেদ। ব্রহ্মকে তাই চৈতন্য বলা হয় — যে চৈতন্যের আলোয় জীবকূল হয়ে ওঠে চেতন (sentient) এবং এই জগৎকে অনুভব করে, যে চৈতন্য ব্যতীত কোনো অনুভূতি বা জ্ঞান সম্ভব নয়। 'অনন্ত', 'অস্তিত্ব', 'চৈতন্য' ইত্যাদি শব্দের দ্বারা ব্রহ্মকে ইঙ্গিত করা হয় যাতে এই জগতে, এই জীবনের মধ্যে দিয়েই সেই সত্যকে খুঁজে নিতে পারি। কিন্তু, সেই পরম সত্য যে আসলে কী বা কেমন তা মনের অগোচর, তাই বাক্যেও প্রকাশ করা যায় না — অবাঙ্মনসগোচরম্। পুরুষের চৈতন্যময় প্রভা ছাড়া প্রকৃতি নিজের গতিময়তাকে প্রকাশ করতে পারে না, আবার প্রকৃতির গুণ ও গতিময়তা ছাড়া নিশ্চল নির্গুণ পুরুষও ব্যক্ত হয় না — কিন্তু সবটাই সেই অদ্বয় ব্রহ্ম। তিনি কখন, কেন, কিভাবে পুরুষ ও প্রকৃতি রূপে প্রতীয়মান হন? যিনি কাল, নিমিত্ত বা কার্য-কারণের ঊর্ধ্বে, তাঁর ক্ষেত্রে এই প্রশ্নগুলো প্রযোজ্য নয়।

1



  1