ভারতবর্ষের সংবিধান অনুযায়ী ভারত এক ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র আবার কোথাও কোথাও ভারতবর্ষকে কোন এক নির্দিষ্ট ধর্মের দেশে রূপান্তরিত করার চেষ্টাও বহু যুগ ধরে চলে আসছে তবে এত শত চেষ্টা বা সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতার তকমা থাকা সত্ত্বেও ভারতবর্ষে বহুকাল ধরে ক্রিকেট-রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে তা নিয়ে দ্বিমত মনে হয় খুব বেশি নেই। ভারতীয় ক্রিকেটের প্রথম অধিনায়ক কর্নেল সি কে নাইডু থেকে শুরু করে সুনীল গাভাস্কার বা সচিন তেন্ডুলকর এর যুগ পেরিয়ে বর্তমানে বিরাট কোহলি রোহিত শর্মার যুগ। সর্বক্ষেত্রেই আমরা তাদেরকে প্রায় ভগবানের সমতুল্য জায়গাটা দিয়ে রেখেছে আবার কোথাও কোথাও তাদেরকে আমরা এক্কেবারে আমাদের পরিবারের সদস্যের মতো ভাবতে শুরু করি। আজকের এই বইটিতে বর্তমান ভারতের তেমনি এক ভগবান বা আমাদের পরিবারের এক সদস্য রোহিত শর্মার দ্বিতীয় ইনিংস বা রূপান্তরের ঘটনাটি বর্ণিত রয়েছে।
2007 সালের দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত হওয়া টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মধ্য দিয়ে বিশ্ব ক্রিকেটের পদার্পণ হলেও বিশ্ব ক্রিকেটে নিজের প্রভাব বিস্তার করতে সেরকম ভাবে সফল হয়নি ভারতীয় ক্রিকেটের নার্সারি মুম্বাই থেকে উঠে আসা এই তরুণ খেলোয়াড়। তবে তার ভেতরে যে প্রতিভার কোন অভাব ছিল না সেটা তার ব্যাটিং দেখেই বলে দেওয়া সম্ভব ছিল কিন্তু সেই প্রতিভাকে ফলাফলে রূপান্তরিত করার মন্ত্রটা হয়তো তরুণ রোহিতের জানা ছিল না। আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান এবি ডি ভিলিয়ার্স বলেছিলেন, "যদি তোমার কোনো প্রতিভার অপচয় দেখতে হয় তাহলে রোহিত এর চোখের দিকে তাকাও।"
ওপিনিংব্যাটিং থেকে শুরু করে মিডিল অর্ডার-লোয়ার মিডিল অর্ডার সবক্ষেত্রেই রোহিতকে অন্তত কয়েক বার যাচাই করে দেখেছিল টিম ম্যানেজমেন্ট কিন্তু তা সত্ত্বেও কোথাও যেন সেইসব সুযোগের সদ্ব্যবহার তিনি করতে পারছিলেন না। ক্রিকেটের কণ্ঠ নামে পরিচিত হার্শা ভগ্লে রোহিত কে নিয়ে এক জায়গায় মন্তব্য করেন, "আমি জানিনা কি ধরনের মানুষ তিনি, কেমন করে একজন মানুষ এতগুলো সুযোগ নষ্ট করতে পারে।"
আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বারংবার ব্যর্থ হলেও ঘরোয়া ক্রিকেটে রোহিতের পারফরম্যান্স প্রতিবার তাকে ভারতীয় ক্রিকেটের দোরগোড়ায় দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল। নির্বাচকরা কোনভাবে ঘরোয়া ক্রিকেটে তার পারফরম্যান্স কে উপেক্ষা করতে পারেনি। সেই কারণেই হয়তো 2007 থেকে আজ পর্যন্ত প্রায় সবসময়ই ভারতীয় ক্রিকেটের সঙ্গে ছিলেন এই মর্ডান মাস্টার।
অবশেষে 2013 চ্যাম্পিয়নস ট্রফিতে বিশ্ব ক্রিকেট খুঁজে পায় তার এযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্রিকেটার কে। সেই সময় বলা হচ্ছিল এই হয়তো রোহিতের শেষ সুযোগ নিজেকে ও নিজের প্রতিভাকে সঠিক পরিচয় দেবার। দলে প্রথম বা প্রধান ওপেনিং জুটি হিসেবে জায়গা করেছিলেন মুরালি বিজয় ও শিখর ধাওয়ান কিন্তু প্রস্তুতি ম্যাচে বিজয়ের খারাপ পারফরম্যান্স মিডিল অর্ডারে বসে থাকা রোহিত শর্মাকে ওপেন ব্যাট করার সুযোগ করে দেয়। তারপর থেকে আর ফিরে তাকাতে হয়নি মুম্বাইয়ের এই বহুচর্চিত প্রতিভাকে।
সবাই বলে রোহিত ভগবান প্রদত্ত এক প্রতিভার অধিকারী কিন্তু প্রতিভা তো অনেকেরই থাকে সেই প্রতিভাকে সঠিকভাবে রূপান্তর করার ক্ষমতা বা পরিশ্রম কয়জন করতে পারে ? রোহিত শর্মার গল্পটা যতটা ভাগের তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি মানসিক লরাইয়ের।
অসামান্য এক প্রতিভার অধিকারী হওয়া সত্বেও বারবার নিজের ব্যর্থতাকে এত কাছ থেকে দেখা এবং তারপর হাল না ছেড়ে নিজেকে লড়াইয়ের ময়দানে টিকিয়ে রাখার আরেক নাম রোহিত গুরুনাথ শর্মা। সম্প্রতি যখন আমরা মানসিক বিষাদ, ব্যর্থতা এবং যার থেকে তৈরি হওয়া নানা রকম মানসিক সমস্যার কথা জানতে পারছে সেই জায়গায় দাঁড়িয়ে রোহিত শর্মার গল্প নিঃসন্দেহে প্রেরণা যোগাবে। ক্রিকেট যে টেকনিক বা শারীরিক শক্তির থেকে অনেক বেশি মানসিক শক্তি দ্বারা প্রভাবিত রোহিত শর্মার দ্বিতীয় ইনিংস। বা বারহিত 2.0 সেটারই নিদর্শন।
এযুগের নামিদামি ব্যাটসম্যানরা যখন 100 করে আউট হয় তখন আমরা বলে থাকি একটা অসাধারণ ইনিংস খেলে আউট হলেন অমুক কিন্তু রোহিত সেঞ্চুরি করে আউট হলে আমরা বলি একটা 200 রান মিস করলেন তিনি। হয়তো এটাই রোহিত শর্মাকে বাকি সবার থেকে আলাদা করে।