যোগ, লেখক : তাপস ঘোষ

profile
Tapas Ghosh
Jun 22, 2020   •  22 views

আমাদের ঋষিরা যে চারটি আধ্যাত্মিক পথের কথা বলেছেন সেগুলি হল :

(১) জ্ঞানযোগ

( ২) কর্মযোগ

(৩) ভক্তিযোগ এবং

(৪) রাজযোগ।

যদিও উক্ত চারটি পথই 'যোগ', তবু এই চারটি পথের মধ্যে একমাত্র রাজযোগকেই সংক্ষেপে 'যোগ ' নামে অভিহিত করা হয়।

রাজযোগ সম্পর্কে অতি সংক্ষেপে স্বামীজি বলছেন : ''যোগীগণের মতে মেরুদন্ডের মধ্যে ইড়া ও পিঙ্গলা নামক দুইটি স্নায়বীর শক্তিপ্রবাহ ও ‘সুষুম্না’ নামে একটি শূন্য নালী আছে। এই শূন্য নালীর নিম্নপ্রান্তে ‘কুন্ডলিনী পদ্ম’ অবস্থিত, যোগীরা বলেন, উহা ত্রিকোণাকার। যোগীদের রূপক ভাষায় ঐ স্থানে কুন্ডলিনী শক্তি কুন্ডলাকৃতি হইয়া বিরাজমানা।

যখন এই কুন্ডলিনী জাগরিতা হন, তখন তিনি এই শূন্য নালীর মধ্য দিয়া পথ করিয়া উঠিবার চেষ্টা করেন, এবং যতই তিনি এক-এক সোপান উপরে উঠিতে থাকেন, ততই মনের যেন স্তরের পর স্তর খুলিয়া যাইতে থাকে; ..... যখন সেই কুন্ডলিনী মস্তিষ্কে উপনীত হন, তখন যোগী সম্পূর্ণরূপে শরীর ও মন হইতে পৃথক্ হইয়া যান এবং তাঁহার আত্মা স্বীয় মুক্তভাব উপলদ্ধি করে।

আমরা জানি সুষুম্নাকান্ড (Spinal cord) এক বিশেষ প্রকারে গঠিত, ৪-এই অক্ষরটিকে যদি লম্বালম্বি ভাবে (∞) লওয়া যায়, তাহা হইলে দেখা যাইবে যে, উহার দুইটি অংশ রহিয়াছে এবং ঐ দুইটি মধ্যদেশে সংযুক্ত। এইরূপ অক্ষর, একটির উপর আর একটি সাজাইলে যেরূপ দেখায়, সুষুম্নাকান্ড কতকটা সেইরূপ। উহার বামভাগ ‘ইড়া’, দক্ষিণ ভাগ ‘পিঙ্গলা’ এবং যে শূন্য নালী সুষুম্না-কান্ডের ঠিক মধ্যস্থল দিয়া গিয়াছে-তাহাই ‘সুষুম্না’। কটিদেশের নিকট মেরুদন্ডের কতকগুলি অস্থির পরেই সুষুম্নাকান্ড শেষ হইয়াছে, কিন্তু তাহা হইলেও একটি অতিসূক্ষ্ম তন্তু বরাবর নিম্নে নামিয়া আসিয়াছে। সুষুম্না নালী ঐ তন্তুর মধ্যেও অবস্থিত, তবে অতি সূক্ষ্ম হইয়াছে মাত্র। নিম্নদিকে ঐ নালীর মুখ বন্ধ থাকে। উহার নিকটেই কটিদেশস্থ স্নায়ুজাল (Sacral plexus) অবস্থিত। আধুনিক শারীরবিজ্ঞানের (Physiology) মতে-উহা ত্রিকোণাকৃতি। বিভিন্ন স্নায়ুজালের কেন্দ্র সুষুম্নার মধ্যে অবস্থিত; ঐগুলিকেই যোগিগণের ভিন্ন ভিন্ন পদ্মরূপে গ্রহণ করা যাইতে পারে।

যোগী কল্পনা করেন, সর্বনিম্নে মূলাধার হইতে আরম্ভ করিয়া মস্তিষ্কে সহস্রার বা সহস্রদল পদ্ম পর্যন্ত কতকগুলি কেন্দ্র আছে। যদি আমরা ঐ পদ্মগুলিকে পূর্বোক্ত স্নায়ুজাল (Plexus) বলিয়া মনে করি, তাহা হইলে আধুনিক শারীরবিজ্ঞানের ভাষায় অতি সহজে যোগীদিগের কথার ভাব বুঝা যাইবে। আমরা জানি, আমাদের স্নায়ুমধ্যে দুই প্রকারের প্রবাহ আছে; তাহাদের একটিকে অন্তর্মুখ ও অপরটিকে বহির্মুখ, একটিকে সংবেদাত্মক (sensory) ও অপরটিকে চেষ্টাত্মক (motor), একটিকে কেন্দাভিগ ও অপরটিকে কেন্দ্রাতিগ বলা যাইতে পারে। উহাদের মধ্যে একটি মস্তিষ্কের অভিমুখে সংবাদ বহন করে, অপরটি মস্তিষ্ক হইতে বাহিরে সমুদয় অঙ্গে সংবাদ লইয়া যায়।... "

রাজযোগ অবলম্বন করতে হলে চাই সুস্থ সবল শরীর। দুর্বল ও রোগগ্রস্ত শরীর নিয়ে রাজযোগ চর্চা করা যায়না। তাই ভারতীয় ঋষিরা রাজযোগ অভ্যাসের প্রারম্ভে শরীর সবল ও সুস্থ রাখার যে উপায় নির্দেশ করেছেন সেটা চিহ্নিত হয়েছে ' হটযোগ ' নামে। বর্তমানে 'যোগ ' বলতে যে বিভিন্ন যোগাসন ও শারীরিক প্রক্রিয়ার কথা প্রচারিত হয়, ওগুলো আসলে হটযোগের প্রক্রিয়া। হটযোগের উদ্দেশ্য শরীরকে রাজযোগের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা, এবং রাজযোগের উদ্দেশ্য পরমাত্মার সন্ধান ।

আমাদের দুর্ভাগ্য যে , বর্তমানে রাজযোগের চেয়ে হটযোগ অনেক বেশি জনপ্রিয় এবং অধিকাংশ মানুষই 'যোগ ' বলতে শুধুমাত্র এই হটযোগকেই বুঝে থাকেন। সম্ভবত আধ্যাত্মিকতাকে ভুলে শুধুমাত্র শরীরকেন্দ্রিক হওয়ার জন্যই আমরা রাজযোগের চেয়েও হটযোগকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে ফেলছি। কিন্তু প্রাচীন ভারতে হটযোগের মাধ্যমে দৈহিক সুস্থতালাভকে উপায় হিসাবে ভাবা হত, উদ্দেশ্য হিসাবে নয়। উদ্দেশ্য ছিল একমাত্র আত্মজ্ঞান বা জীবাত্মার সাথে পরমাত্মার মেলবন্ধন।...

0



  0