মন্ত্র ও শ্রীরামকৃষ্ণের রূপ

profile
Uttoran Roychowdhury
Nov 24, 2022   •  23 views

মননাৎ ত্রায়তে ইতি মন্ত্র – অর্থাৎ যা মনন করলে তা আমাদের (সংসার সমুদ্র থেকে) ত্রাণ করে সেটিই হল "মন্ত্র"। পণ্ডিত শিবদাস বিদ্যার্ণব ভট্টাচার্য তাঁর তন্ত্রতত্ত্বে বলছেন অর্থযুক্ত মন্ত্রের চিন্তন হচ্ছে ধ্যান, আর অর্থ বলতে এখানে ইষ্টদেবতার রূপ। অর্থাৎ এই ক্ষেত্রে ইষ্টমন্ত্র ও ইষ্টের রূপ একসাথে চিন্তনের নাম ধ্যান। যাঁরা দীক্ষাগ্রহণ করেছেন তাঁরা এই বিষয়টি হয়তো বুঝতে পারছেন।
এবার দীক্ষার সময়ে গুরু যে মন্ত্র দেন তাতে সাধারণত চারটি অংশ থাকে – প্রণব, বীজ, ইষ্টের নাম এবং তাঁর প্রতি প্রণাম নিবেদন।
• প্রণব (ॐ) হল অখণ্ড নির্গুণ ব্রহ্মের প্রতীক।
• যে বীজমন্ত্রটি থাকবে সেটি সগুণ ব্রহ্ম বা অনন্তভাবময় ঈশ্বরের প্রতীক।
• ইষ্টের নাম – অর্থাৎ কোনো দেব/দেবী (ঈশ্বরের কোনো একটি বিশেষ রূপ)-এর নাম অথবা অবতারের নাম।
• উপরোক্ত এই তিনকে স্বরূপত এক ও অভিন্ন জেনে প্রণাম নিবেদন।
ইষ্টের রূপ যদি মন্ত্রের অর্থ হয় তাহলে গুরুপ্রদত্ত মন্ত্রের এই সঠিক বিশ্লেষণ ইষ্টের রূপের মধ্যেই পাওয়া যাবে। ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণদেবের যে আলোকচিত্রটি আমরা পূজা করি, যার উপর ধ্যান করি – সেই চিত্রে তাঁর ফুটে ওঠা রূপের মধ্যে দিয়ে কি আমরা সেই অর্থ খুঁজে পাই?

images-17--lav39x2u


■ শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ যদি ইষ্টদেবতা হন তবে তাঁর এই রূপ ঈশ্বরেরই বিশেষ প্রকাশ। আমরা যদি তাঁর ছবিটি ভাল করে লক্ষ্য করি, দেখব তাঁর দেহে কিছু বিশেষ লক্ষণ রয়েছে – বিশেষত তাঁর কাঁধ থেকে শুরু করে পেট ও হাত অবধি। তাঁর দক্ষিণদিকের (অর্থাৎ আমাদের বামদিক থেকে) কাঁধের আকার বড়, তুলনামূলকভাবে তাঁর বামদিকের (অর্থাৎ আমাদের ডানদিক থেকে) কাঁধ কিছুটা ছোট। তাঁর ডানহাতও আকারে যেন বড় এবং পুরুষালী, আর বামহস্ত যেন কিছুটা ছোট ও কোমল। তাঁর ডানদিকের বুক পুরুষের মতোই স্বাভাবিক হলেও বামদিকের বুক যেন কিছুটা নারীসুলভ। হ্যাঁ, তাঁর এই রূপের আড়ালেই লুকিয়ে রয়েছে এক গূঢ় রহস্য – তাঁর দক্ষিণ দিক "পুরুষ" এবং বামদিক "প্রকৃতি" বোঝায়।
■ পুরুষ হলেন চৈতন্যস্বরূপ সত্তা যিনি প্রকৃতির সাক্ষী এবং তাকে প্রকাশ করেন অথচ নিজে নিশ্চল ও অব্যক্ত, আর প্রকৃতি হলেন সেই গতিময় সত্তা যাঁর থেকে জগতের সকল সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের খেলা চলছে, কিন্তু প্রকৃতি নিজে জড় তাই তিনি বা তাঁর এই নিত্য ক্রীড়া পুরুষ ব্যতীত প্রকাশিত হয় না। তাই পুরুষ এই গতিময় ক্রীড়াকে প্রকাশিত করে প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে নিজেকে ব্যক্ত করলে এমন বোধ হয় যেন সেই চৈতন্যস্বরূপ সত্তাই স্বয়ং এই সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশের লীলা রচনা করে নিজেকেই এই জগৎ রূপে প্রকাশ করছেন – এনাকেই আমরা সগুণ ব্রহ্ম বা ঈশ্বর বলি।
■ অর্থাৎ, একসাথে পুরুষ ও প্রকৃতির মিলনেই ঠাকুরের এই রূপ – তিনিই ঈশ্বর।
■ আবার একই দেহ এক অর্ধে পুরুষ হয়েছে ও অপর অর্ধে প্রকৃতি – আমরা জানি যে সেই 'এক' অখণ্ড গুণাতীত ব্রহ্মই 'দুই' রূপে প্রতীয়মান – জ্ঞাতা "পুরুষ" ও জ্ঞেয় "প্রকৃতি"। এর দ্বারা আমরা ধারণা করতে পারি ঠাকুরই স্বরূপত নির্গুণ ব্রহ্ম।

● অর্থাৎ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের এই রূপের মধ্যে দিয়ে আমরা বুঝলাম – যিনি ইষ্ট (রামকৃষ্ণ) তিনিই সেই অনন্তভাবময় ঈশ্বর, তিনিই স্বরূপত নির্গুণ ব্রহ্ম – এই তিনকে এক জেনে আমার প্রণাম নিবেদন করি। তাই ভগবানের এই রূপের মধ্যে আমরা ইষ্টমন্ত্রের সঠিক অর্থ পেতে পারি।

আপাতভাবে এই আলোকচিত্র দেখলে বোঝা যায় না ঠিকই, মনে হয় তিনি সোজা ও স্বাভাবিকভাবেই উপবিষ্ট, তাঁর শরীর মোটামুটি প্রতিসম ভাবেই রয়েছে যেন – কিন্তু তা আসলে নয় (ছবিটির প্রতিবিম্ব দেখলেই বোঝা যাবে)। এ এক রহস্যময় ছবি।

0



  0