এক অসীম নিত্য অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই নেই। এই অনাদি অনন্ত সত্তাই জগতরূপে প্রতীয়মান, এক অদ্বৈত সত্য প্রকাশিত বৈচিত্র্যময় বহুত্বের জগতরূপে। কিন্তু কীভাবে? রজনীকান্ত সেনের ভাষায় বললে - "আমি কী বা বুঝি, আমি কী বা জানি, আমি কেন ভেবে মরি হে?"

এই পরম সত্য নিরাকার নির্গুণ স্বপ্রভ চিৎস্বরূপ। চিৎ অর্থাৎ চৈতন্য (মহাপ্রভু নয়) বা ইংরেজিতে যাকে Consciousness বলে। এই অনন্ত Consciousness-এর স্বভাবই হল সবকিছুকে স্বপ্রভায় প্রকাশ করা এবং জানা। কিন্তু কাকে প্রকাশ করবেন? কাকে জানবেন? কারণ তিনি ছাড়া যে আর কিছুই নেই - তিনিই তো একমাত্র নিত্য অস্তিত্ব। জানার জন্য বা প্রকাশ করার জন্য তো অন্তত দুটি পৃথক বস্তু প্রয়োজন, যেমন জ্ঞাতা (subject) ও জ্ঞেয় (object)। চোখ সমস্ত পৃথক আকার ও রঙকে সরাসরি দেখতে পায় কিন্তু নিজেকে সরাসরি দেখতে পায় না। তাছাড়া অনন্তকে যে জানাও সম্ভব নয়। কী হয় যখন একটা অপ্রতিরোধ্য বল সম্মুখীন হয় একটা অটল বস্তুর? ভ্রান্তি। তেমনই এখানে সেই অনন্ত চৈতন্যের স্বভাব হল সবকিছু জানা, অথচ জানার মতো কোনো পৃথক বস্তু এখানে নেই, আছেন শুধু তিনি নিজেই এবং তাঁকে জানাও সম্ভব নয় - আর তাই এখানেই রয়েছে অনাদি অনির্বচনীয় 'মায়া'। এক ও অবিভাজ্য সত্তা মায়ায় প্রতীয়মিত হয় দু'টি সত্তা হিসেবে - ১) পরমপুরুষ শিব এবং ২) পরমাপ্রকৃতি শক্তি। কে এই শিব? শক্তিই বা কে? 

পরমপুরুষ শিব অর্থে এখানে শুধুই কৈলাসে ধ্যানমগ্ন থাকা জটাধারী আদিযোগী নন - শিব হলেন সেই নিরাকার নির্লিপ্ত সাক্ষীস্বরূপ পরমজ্ঞাতা। নিশ্চল শিবের মধ্যেই সদা নৃত্যরতা সেই শক্তি - এই হলেন চিন্ময়ী পরমাপ্রকৃতি। শিব হলেন এই শক্তির অশেষ গতিময়তার সাক্ষী। শিবের আলোতেই প্রকাশ পায় শক্তির এই অবিরত খেলা। আমরা মা কালীর মূর্তির দিকে যদি একবার তাকাই তবে দেখব যে কালী হলেন সেই প্রচণ্ড গতিময় শক্তি যিনি অসুর সংহার করেন আবার ভক্তকে বরাভয় প্রদান করেন, সৃষ্টি-স্থিতি-বিনাশ তাঁর নিত্য ক্রীড়া যেন - আর তাঁর সেই লীলার সাক্ষী হিসেবে তাঁরই পদতলে রয়েছেন নির্বিকার শিব। এতকিছুর মধ্যেও মনে রাখতে হবে যে শিব আর শক্তি কিন্তু ভিন্ন সত্তা নন, সেই একই পরম সত্যের দুই প্রকাশ। শুধু তাই নয়, আগুন ও তার দহন করার শক্তি যেমন অভেদ, অর্থাৎ আগুনকে ভাবলে যেমন তার দাহিকা শক্তিকে ভাবতেই হয় আবার দাহিকা শক্তি ভাবলে যেমন আগুনকে ভাবতেই হয় - ঠিক তেমনই অভেদ এই শিব ও শক্তি। শিব হলেন এক অনন্ত সাগর, এবং যাঁর কারণে সেই সাগরে অবিরাম লহরীর গড়া ও ভাঙার খেলা চলে তিনিই হলেন শক্তি। ঢেউগুলি (যা এক্ষেত্রে জীব ও জগত) আসলে স্বয়ং শক্তিরই প্রকাশ। সাগর এবং তার ঢেউয়ের ভাঙাগড়ার খেলা কিন্তু অভেদ - একটিকে ভাবলে অন্যটিকে ভাবতেই হয়। আবার সাগর ও লহরী আসলে জল ছাড়া কিছুই নয়, সবটাই শুধু জল - এই জলই যেন এক্ষেত্রে সেই অনন্ত অস্তিত্ব, কারণ এই জলই প্রকাশিত সাগর ও তার লহরী রূপে। তাই যিনি শক্তি তিনিই শিব - তিনিই সেই অদ্বৈত পরম সত্য।

এই শক্তির ইচ্ছাতেই জগত চলছে, কিন্তু কীভাবে?

দেবী শক্তি সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্মা হয়েও নিজেকে প্রকাশ করেন স্থূল থেকে স্থূলতর রূপে। তিনি প্রথমে প্রকাশিত হন 'আকাশ' রূপে - এই আকাশ হল শব্দের অনুভূতির সাথে সম্পর্কিত। এই আকাশ থেকেই তিনি প্রকাশিত হন 'বায়ু' রূপে - বায়ুর সম্পর্ক শব্দ ও স্পর্শের অনুভূতির সাথে। বায়ু থেকে আরও স্থূলতর হয়ে তিনি হন 'তেজ' - এই তেজ হল শব্দ, স্পর্শ ও রূপের (বা দৃষ্টির) অনুভূতির সঙ্গে সম্পর্কিত। আরও স্থূলতর হয়ে তিনি প্রকাশিত হন 'জল' রূপে - শব্দ, স্পর্শ, রূপ ও রসের সাথে সম্পর্কিত এই জল। জল থেকেই প্রকাশিত হয় তাঁর আরও স্থূলতর রূপ 'পৃথ্বী' যা কিনা শব্দ, স্পর্শ, রূপ, রস ও গন্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত। এই হল 'পঞ্চমহাভূত'। সত্ত্ব, রজঃ ও তমঃ - এই তিন গুণের অধিকারী হয়েও তাদের দ্বারা আবদ্ধ ও প্রভাবিত নন তিনি - তাই ত্রিগুণাত্মিকা হয়েও তিনি ত্রিগুণাতীতা। পঞ্চভূতের সংমিশ্রণে গুণত্রয়ের তারতম্যে তিনি এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টি করেন। মনে রাখতে হবে যে এই পঞ্চভূত তাঁরই প্রকাশ, তাই এই সমগ্র বিশ্বব্রহ্মাণ্ড রূপে তিনিই প্রকাশিত। তাই তিনি ঘোষণা করেন, "এই জগতে আমিই একমাত্র, আমি ভিন্ন দ্বিতীয় আর কে আছে?" আবার এই অখিল জগতের মাতা হিসেবে তিনিই এর লালন পালন করেন এবং সময়মতো জগতের বিনাশ করে তিনি শিব সত্তায় আত্মলীন হয়ে অব্যক্ত অবস্থায় ফিরে যান। আবার তিনি সৃষ্টির বীজ বপন করেন, আর এভাবেই তাঁর সৃষ্টি-স্থিতি-প্রলয়ের অবিরাম খেলা চলতেই থাকে। তাঁর এই প্রচণ্ড লীলা প্রতিভাত হয় শিবের আলোয়, শিবই সবকিছুর সাক্ষী।

এই জগতে যা কিছু হচ্ছে - জন্ম, বৃদ্ধি, ক্ষয়, মৃত্যু, উৎসব, দুর্যোগ - সব এই দেবী শক্তির ইচ্ছেতেই হচ্ছে, এটা তাঁর নিত্য খেলা। সকলকে দিয়ে যা করানোর তিনিই করাচ্ছেন - "তোমার কর্ম তুমি করো মা, লোকে বলে করি আমি"। নিঃশ্বাস-প্রশ্বাস, হৃৎস্পন্দন, ক্ষুধা, নিদ্রা, পাচন, রেচন - শরীরের এই সমস্ত কিছু আমরা নিজেরা কতটুকুই বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি? ভাল করে ভাবলে দেখতে পাব যে এগুলো সবই যেন এক অজানা শক্তির নিয়ন্ত্রণে নিজে থেকেই হয়ে চলেছে। পরমাপ্রকৃতি স্বয়ং আমাদের মধ্যে প্রাণশক্তিকে ইচ্ছামতো চালিত করে এক অদ্ভুত ছন্দে সমস্ত প্রক্রিয়াকে সম্পন্ন করে চলেছেন। শুধু শরীর কেন? জগতের সবকিছুই কেমন এক অদ্ভুত সুন্দর ছন্দে হয়ে চলেছে। আমরা কেবলই এই লীলার সাক্ষী মাত্র। তিনিই কাউকে আত্মজ্ঞান প্রদান করে মুক্ত করেন, আবার কাউকে অধোগামী করে সংসারে আরও আবদ্ধ করেন - সন্তানের সাথে খেলতে তিনি ভালবাসেন। তাঁর সঙ্গে শুধুই এক শুদ্ধ প্রেমের সম্পর্ক, মা আর সন্তানের যেমন হয়। তিনি সন্তানকে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে ভোগ করার মতো নানারকম খেলনা দিয়ে ভুলিয়ে রাখেন। ভোগের চরমে পৌঁছোলে যখন আর সেই খেলনা ভাল লাগে না, সেইসব ছুড়ে ফেলে সন্তান শুধু "মা মা" বলে কাঁদতে থাকে - তখন মা আসেন সন্তানকে নিজের কোলে নিতে। সন্তান তখন বোঝে যে 'এক অসীম নিত্য অস্তিত্ব ছাড়া আর কিছুই নেই'।

0



  0