গীতাপাঠ ও ফুটবল নিয়ে স্বামীজি ঠিক কী বলেছেন?

profile
Uttoran Roychowdhury
Jan 12, 2020   •  1179 views

“গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরও নিকটবর্তী হইবে” – স্বামী বিবেকানন্দের বহুল প্রচলিত এই কথাটি আমরা সকলেই শুনে এসেছি। কিন্তু এই কথাটিকে প্রসঙ্গ-বহির্ভূতভাবে ব্যবহার করে যে ভুল ব্যাখ্যা আজ অবধি করা হয়েছে তার কোনো শেষ নেই! অনেকে বলেন যে স্বামীজি নাকি বলেছেন যে গীতাপাঠের থেকে ফুটবল খেলা শ্রেয়, গীতাপাঠ করলে আদৌ পুণ্যলাভ হয় না, তাই ওইসব ‘গীতা’ জাতীয় শাস্ত্রীয় গ্রন্থ ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ফুটবল খেলায় মন দেওয়া প্রয়োজন। এমনটা যারা মনে করে তাদের দুঃখের সাথে জানাতে বাধ্য হচ্ছি যে স্বামীজি একথা মোটেই বলেননি। উপনিষদে বলছে, “নায়মাত্মা বলহীনেন লভ্য” – অর্থাৎ বলহীনের দ্বারা আত্মজ্ঞান লাভ হয় না। আত্মজ্ঞান – যা লাভ করলে মানুষ সংসারের দুঃখ-সুখের চক্র থেকে মুক্ত হয়ে স্থায়ী আনন্দ ও শান্তি প্রাপ্ত হয়। যারা শারীরিক ভাবে দুর্বল, যারা মানসিক ভাবে দুর্বল – তারা এই জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হবে না। শরীরচর্চার মাধ্যমে শরীরকে আগে সুস্থ ও সবল করে তুলতে হবে, তারপর মনকেও দৃঢ় করতে হবে, তবেই আমরা গীতায় শ্রীকৃষ্ণের কথার অর্থ উদ্ধার করে আত্মজ্ঞানলাভের পথে অগ্রসর হতে পারব। তাছাড়াও স্বামীজি যে সময়ে ভারতে এই বক্তব্য রাখছেন তখন ভারতীয়রা পরাধীনতার শিকলে বন্দী হয়ে নিজেদের গৌরবময় ইতিহাসকে ভুলে গিয়েছে – তারা চরম তামসিকতায় ডুবে রয়েছে তখন। আলস্য, কুঁড়েমি, দাসত্ব, স্বার্থপরতা ইত্যাদি তামসিক গুণ তাদের গ্রাস করেছে। মনুষ্যজীবনে তামসিকতা থেকে রাজসিকতায় উন্নীত হয়ে তবেই সাত্ত্বিকতার দিকে পৌঁছোনো সম্ভব, কারণ রাজসিক কর্ম তামসিকতাকে দূর করে এবং তমোগুণ নিষ্ক্রিয় হলে তবেই ঠিক ঠিক সাত্ত্বিক হওয়া যায়। শরীরচর্চা হল রাজসিক এবং আধ্যাত্মিকতা হল সাত্ত্বিক। তাই স্বামীজি সেইসময়ে ভারতীয়দের উদ্দেশ্যে বলছেন যে তারা যেন ফুটবল খেলা জাতীয় শরীরচর্চার মাধ্যমে আগে তাদের তামসিকতা কাটিয়ে উঠে সবল ও দৃঢ় হতে পারে, অন্যথা তামসিক শরীর ও মন নিয়ে গীতাপাঠ করতে বসলে তাদের কোনোরকম লাভ হবে না। এবার স্বামীজি সেই বক্তৃতায় আসলে কী বলেছিলেন তার উপর ভিত্তি করেই আমার এই ব্যাখ্যা ঠিক কি ভুল তার বিচার পাঠক হিসেবে আপনি করবেন।

স্বামীজি বলছেন, “আমাদের উপনিষদ যতই বড় হউক, অন্যান্য জাতির সহিত তুলনায় আমাদের পূর্বপুরুষ ঋষিগণ যতই বড় হউন, আমি তোমাদিগকে স্পষ্ট ভাষায় বলিতেছি - আমরা দুর্বল, অতি দুর্বল। প্রথমত আমাদের শারীরিক দৌর্বল্য- এই শারীরিক দৌর্বল্য আমাদের অন্তত এক-তৃতীয়াংশ দুঃখের কারণ। আমরা অলস, আমরা কাজ করিতে পারিনা; আমরা এক সঙ্গে মিলিতে পারিনা; আমরা পরস্পরকে ভালোবাসি না; আমরা ঘোর স্বার্থপর; আমরা তিনজন একসঙ্গে মিলিলেই পরস্পরকে ঘৃণা করিয়া থাকি, ঈর্ষা করিয়া থাকি। আমাদের এখন এই অবস্থা- আমরা অতিশয় বিশৃঙ্খল ভাবাপন্ন, ঘোর স্বার্থপর হইয়া পড়িয়াছি- শত শত শতাব্দী যাবত্ এই লইয়া বিবাদ করিতেছি- তিলক ধারণ এইভাবে করিতে হইবে, কি ঐভাবে। কোন মানুষের দৃষ্টিতে আমার খাওয়া নষ্ট হইবে কিনা - এই ধরনের গুরুতর সমস্যার উপর বড় বড় বই লিখিতেছি। যে জাতির মস্তিষ্কের সমুদয় শক্তি এইরূপ অপূর্ব সুন্দর সুন্দর সমস্যার গবেষণায় নিযুক্ত, সে জাতির নিকট হইতে বড় রকমের একটা কিছু আশা করা যায়না, এরূপ আচরণে আমাদের লজ্জাও হয়না! হাঁ, কখন কখনও লজ্জা হয় বটে, কিন্তু আমরা যাহা ভাবি, তাহা করিতে পারিনা। আমরা ভাবি অনেক কিছু, কিন্তু কার্যে পরিনত করিনা। এইরূপে তোতাপাখির মত কথা বলা আমাদের অভ্যাস হইয়া গিয়াছে- আচরণে আমরা পশ্চাত্পদ। ইহার কারণ কি? শারীরিক দুর্বলতাই ইহার কারণ। দুর্বল মস্তিষ্ক কিছু করিতে পারেনা; আমাদিগকে সবল মস্তিষ্ক হইতে হইবে- আমাদের যুবকগণকে প্রথমত সবল হইতে হইবে, ধর্ম পরে আসিবে।
হে আমার যুবক বন্ধুগণ, তোমরা সবল হও - তোমাদের নিকট ইহাই আমার বক্তব্য। গীতাপাঠ অপেক্ষা ফুটবল খেলিলে তোমরা স্বর্গের আরো নিকটবর্তী হইবে আমাকে অতি সাহসপূর্বক এই কথাগুলি বলিতে হইতেছে; কিন্তু না বলিলেই নয়। আমি তোমাদিগকে ভালোবাসি।
...তোমাদের বলি, তোমাদের শরীর একটু শক্ত হইলে তোমরা গীতা আরো ভাল বুঝিবে। ...যখন তোমাদের শরীর তোমাদের পায়ের উপর দৃঢ়ভাবে দন্ডায়মান হইবে, যখন তোমরা নিজেদের মানুষ বলিয়া অনুভব করিবে, তখনই তোমরা উপনিষদ ও আত্মার মহিমা ভাল করিয়া বুঝিবে।...”

1



  1